ইতিহাসে অবহেলিত এক মহান যোদ্ধার ইতিকথাঃ



নাম: হাসান উলুবাতলি।
জন্ম–স্থান: ১৪২৮ খ্রিষ্টাব্দ, বুরসা।
মৃত্যু–স্থান: ২৯ মে, ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ, ইস্তাম্বুল।
কনস্টান্টিনোপল, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী। ক্রুশপূজারিদের স্বর্গরাজ্য। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ এর নেতৃত্বে উসমানি বাহিনী কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করে আছে। ৫৩ দিন গত হয়ে গেছে, কিন্তু কনস্টান্টিনোপল পতনের কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, তখনকার সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত দুর্গপ্রাচীর ছিল কনস্টান্টিনোপলের দুর্গপ্রাচীর। ক্রমবর্ধমান শক্তিধর উসমানি সাম্রাজ্যের হাত থেকে রক্ষা করতে ক্রুশপূজারিরা দুর্গপ্রাচীরকে খুবই মজবুত করে রেখেছে। মাত্র ২৪ বছর বয়সী তরুণ উসমানি সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ কনস্টান্টিনোপল জয় করা ছাড়া সালতানাতের রাজধানী বুরসায় না ফিরে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করেছেন।
হাসান উলুবাতলি। জন্ম ১৪২৮ সালে। তুরুস্কের বুরসা প্রদেশের অন্তর্গত কারাচাবের নিকটস্থ উলুবাত নামক গ্রামে। ২৫ বছর ছুঁই ছুঁই একজন তাগড়া নওজোয়ান। উসমানি সাম্রাজ্যের দুর্দান্ত 'জানিসারি বাহিনী'র মারকুটে সৈনিক। স্কটিশ ইতিহাসবিদ লর্ড কিনরোজের লেখা “দ্য অটোমান সেঞ্চুরিস” অনুযায়ী তিনি খুব দীর্ঘদেহী ব্যক্তি ছিলেন। “উলুবাতলি হাসান” নামের অর্থ “উলুবাতের হাসান”। কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের সময় তাঁর বীরোচিত ভূমিকার কারণে আজও তাকে বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়।
১৪৫৩ সালে এপ্রিল মাসে যখন সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ কন্সটান্টিনোপল বিজয় এর উদ্দেশ্য সামরিক যাত্রা শুরু করেন তখন উলুবাতলি হাসান তার অজেয় জেনিসারী বাহিনীর ২৫ বছরের এক যোদ্ধা ছিলেন।
লাগাতার ৫৩ দিন ভয়াবহ কামান গোলা বর্ষন করার পরেও সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না কন্সটান্টিনোপল এর দেয়ালের বিপক্ষে। কেননা কন্সটান্টিনোপল পরপর ৩টি দেয়াল দ্বারা পূর্ণরূপে সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু এত ভারী গোলা বর্ষণের কারনে দেয়ালে বেশ ভালই ফাটল ধরেছিল।
১৪৫৩ সালের ২৯ মে ফজরের নামাজের পর সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ তার শেষ এবং সবথেকে ভয়ানক আক্রমণ শুরু করেন। অটোমান জেনিসারীরা একসাথে কন্সটান্টিনোপলের ভিতর ঢুকতে শুরু করে।
কিন্তু বাইজেন্টাইন সম্রাট কন্সটান্টিন ১১ এর নগর সুরক্ষায় নিয়োজিত ছিল সেসময়ের যুদ্ধপটু জলদস্যু জেনোইজ জিওভান্নি যাস্টিনিয়ান্নি লংগো। তার শক্ত অবস্থান এর কারনে হাজার হাজার জেনিসারী মারা যেতে থাকে অটোমানদের মনোবল ক্ষুন্ন হতে শুরু করে!
খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও নাজুক সেই মুহূর্তে হাসান উলুবাতলি যুগান্তকারী একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। একাই দুর্গের প্রাচীরে চড়ে বসবেন বলে ঠিক করেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। একটি তলোয়ার, একটি ছোট ঢাল এবং উসমানি পতাকা হাতে নিয়ে তিনি দুর্গপ্রাচীরের দিকে যাত্রা করেন। তার সাহসিকতায় সাহস পায় আরও ৩০ জন সৈন্য। তারা তাকে অনুসরণ করে। তার উদ্দেশ্য ছিল দুর্গপ্রাচীরে উসমানি ঝাণ্ডা উড্ডীন করা।
দুর্গপ্রাচীরের চারিদিকে তুমুল যুদ্ধ চলছে। তরবারির ঝনঝনানি আর শাঁ শাঁ করে আসা তীরবৃষ্টি উপেক্ষা করে দেয়ালের দিকে তীব্র বেগে অগ্রসর হতে থাকেন হাসান। তাঁর পিছু পিছু তার অনুসারীরা। একে একে তাদের ১৭ জন তীরের আঘাতে জমিনে লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু তিনি ছুটে চলছেন। হঠাত একটি তীর এসে তাঁর গায়ে লাগে। তিনি এতে পিছপা হন না। যন্ত্রণা উপেক্ষা করে এগিয়ে যান। এরপর মই বেয়ে প্রাচীরের উপর উঠতে থাকেন। আরো একটা তীর এসে লাগে তাঁর গায়ে। তিনি পড়তে পড়তে নিজেকে রক্ষা করেন। সব যাতনা সহ্য করে উপরে উঠতেই থাকেন। অবশেষে দুর্গপ্রাচীরে চড়ে বসেন তিনি! আরো কয়েকটি তীর এসে তাঁকে বিদ্ধ করে। কিন্তু সব ব্যথা ভুলে গিয়ে; প্রাচীরের উপর থেকে ক্রুশের পতাকা সরিয়ে, সেকানে উসমানি পতাকা উড্ডীন করেন!
তখন বৃষ্টির মতো তীর তার দিকে ধেয়ে আসছিল। তীরের আঘাতে আঘাতে তিনি ঝাঁঝরা হচ্ছিলেন। তবুও নিজের শরীর দিয়ে পতাকা রক্ষা করে যেতে থাকলেন। ঠিক সেই সময় তার কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয় তার অনুসারীদের মধ্য থেকে ১২ জন অনুসারী। তারা তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না হাসান; ঢলে পড়লেন এবং সাথে সাথেই শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে নিলেন। পরে দেখা যায় তার শরীরে প্রায় ২৭ থেকে ৩০টি তীর বিদ্ধ ছিল।
কনস্টান্টিনোপলের প্রাচীরে উসমানি পতাকা উড়তে দেখে, উসমানি সেনাদের মনোবল সাংঘাতিকভাবে বৃদ্ধি পায়। চূড়ান্ত আঘাত হানার নির্দেশ দেন সুলতান। গগন বিদীর্ণ শব্দে ফেটে পড়তে শুরু করে উসমানীয় কামানগুলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রাচীরের দুর্বল অংশে ফাটল সৃষ্টি হয়। একসময় দেয়াল ধ্বসে পড়ে। সেই ফাটল দিয়ে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো উসমানি সেনারা ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে। বিজিত হয় কনস্টান্টিনোপল। ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয় দেড়হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী রোমান সাম্রাজ্য ও তার সভ্যতা। আর সে জায়গা পূরণ করে নেয় ইসলাম। এজন্য কনস্টান্টিনোপলের নাম পালটিয়ে রাখা হয় ইসলাম্বুল। মানে ইসলামের শহর। ইসলাম্বুল থেকে পরে ইস্তাম্বুল।
উলুবাতলি হাসান, যিনি প্রায় ৩০টি তীর বিদ্ধ হয়েও অটোমানদের জন্য পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন যেন তারা সাহসের সাথে আল্লাহর জন্য এই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয় আর কাফির বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মনোবল শেষ হয়ে যায়। ইসলামের ইতিহাসে তিনি একজন অসামান্য বীর হিসাবে পরিচিত লাভ করেন যা ইসলামের সাথে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।

লেখক
Md.Saymun

Post a Comment

Previous Post Next Post